আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গ্রাফিক ডিজাইনের সম্পর্ক প্রতিটি পড়তে পড়তে। জন্মলগ্ন থেকে শুরু হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে গ্রাফিক দ্বারা আবৃত। কিভাবে এতো সম্পর্ক চলুন তার কিছু নমুনা দেখে নেই।
গ্রাফিক ডিজাইনের বিচরন ক্ষেত্র
আমরা প্রতিদিন লেনদেনের জন্য যে হরেক রকমের সুন্দর ডিজাইনের টাকা-পয়সার লেনদেন করি, এই ডিজাইনগুলো একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের করা। জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে প্রতিদিন যে বই পড়ি, খাতায় লিখি বা পেপার-ম্যাগাজিন পড়ি, তার সবকিছুর ডিজাইন একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের করা। পুরো বিশ্বজুড়ে যতো ছোটো-বড় দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের পন্যের প্রচারের জন্য, ব্যবসার প্রচারের জন্য নানারকম পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড বানানো হয়, যার সব ডিজাইন একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের করা। আমরা প্রতিদিন খাবার খাই, অফিসের কাজে ব্যবহারের জন্য নানা রকম প্রযুক্তি পন্য ব্যবহার করি, এই জিনিসগুলো সুন্দর মোড়কে আবৃত থাকে। এইসব মোড়কের ডিজাইন করেন একজন প্রফেশনাল গ্রাফিক ডিজাইনার। এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে বিশ্বজুড়ে রয়েছে কোটি কোটি ওয়েবসাইট, তৈরি হচ্ছে এবং হবে আরো কোটি কোটি ওয়েবসাইট এবং মোবাইল এপ, এইসব কিছুর ডিজাইনও করেন একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। আশা করি বুঝতেই পারছেন গ্রাফিক ডিজাইনের সেক্টর কতো বড় এবং কাজের পরিধি কতো বিশাল।
গ্রাফিক ডিজাইন শেখার আগে যা জানতে হবে
সাধারণত গ্রাফিক ডিজাইন শেখার জন্য আপনার কোনো একাডেমিক ডিগ্রী থাকা কিংবা নেয়ার প্রয়োজন নেই। শুরুতে বেসিক কম্পিউটার যেমন কিভাবে অপারেট করে এবং টুকটাক কাজ জানা থাকলেই হবে। যেমন – মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল এবং পাওয়ার পয়েন্টে মোটামুটি ধারণা থাকলে আপনার জন্য উপকার হবে। ফ্রিল্যান্সিং করার ইচ্ছা থাকলে এবং কাজ শেখার সুবিধার্থে ইন্টারনেট সংযোগ থাকা উচিত। তাহলে আপনি বিভিন্ন রিসোর্স থেকে প্রচুর ডিজাইন দেখতে পারবেন এবং ধারণা নিতে পারবেন কিভাবে কাজ করতে হবে, কি ধরনের প্রোডাক্ট বা ক্যাটাগরির জন্য কি রকম ডিজাইন করা উচিত। ইন্টারনেট ছাড়া আমাদের যেকোনো কিছু শেখার গতিই ধীর হয়ে যায়।
গ্রাফিক ডিজাইনার হতে হলে আকাআকি জ্ঞান থাকা কতোটা প্রয়োজন?অনেকের মনে সন্দেহ থাকে, “আমিতো আকাআকিতে ভালো না, আমি কিভাবে গ্রাফিক ডিজাইন শিখবো?” আকাআকি না জানলেও গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়া যায়, কারন আকাআকি করে যারা ডিজাইন করে সেটা গ্রাফিক ডিজাইনের একটা পার্ট। এই পার্টটি সাধারণত ইলাস্ট্রেশন নামে পরিচিত। এছাড়া লোগো ডিজাইনের জন্য আকাআকি জানা থাকলে অনেক ভালো। তবে প্রিন্ট ম্যাটেরিয়াল ডিজাইন যেমন – পোস্টার, ব্যানার, ফ্লায়ার, ব্রোশিউর, স্যোশাল ব্রান্ডিং ইমেজ, ফটো এডিটিং, ফটো ম্যানিপুলেশন, রিজিউম ডিজাইন, প্যাকেজিং ডিজাইন, ওয়েব এবং মোবাইল ইউআই ডিজাইন সহ আরো বেশ কিছু সাইড আছে যেগুলোতে আপনি আকাআকি গুন ছাড়াই গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে পারবেন।
আকাআকি জ্ঞান থাকা প্রয়োজন হবে যদি আপনি কোনো ক্যারেক্টার ডিজাইন করতে চান, কোনো একটি আবহ বা পরিবেশ নিজের মতো করে আর্ট এর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান। এই ধরনের কাজ গুলোর অনেক চাহিদা রয়েছে এবং এর বাজেটও অনেক। তাই এই সেক্টরের ক্লায়েন্ট অনেকটা স্পেসিফিক। সোজা কথায় বললে, যেসকল কোম্পানির বাজেট অনেক বেশি, অনেক বিলাসী, তারাই মূলত ইলাস্ট্রেশন ডিজাইনারদের হায়ার করে থাকেন। এছাড়া লোগো ডিজাইনের একটি বড় অংশেই আর্ট জানা প্রয়োজন।
গ্রাফিক ডিজাইনারের কাজের পরিধি
গ্রাফিক ডিজাইনের কাজের পরিধি নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব না। কারন এর বিস্তার প্রতিটি পদে পদে। তবুও কিছু ক্ষেত্র জেনা থাকা ভালো যে একজন ডিজাইনার কাজ শিখে কিভাবে এবং কোন কোন সেক্টরে কাজ করতে পারবেন।
লোকাল জবঃ দেশের বিভিন্ন ছোটো-বড় লোকাল এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে তাদের ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিং এর জন্য গ্রাফিক ডিজাইনার হায়ার করে থাকে। সহজভাবে বললে, আপনি ফেসবুক বা অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলে দেখবেন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে তাদের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এই বিজ্ঞাপনগুলোর জন্য তাদের প্রয়োজন হয় সুন্দর ডিজাইনের পোস্টার, ব্যানার এবং অন্যান্য ব্র্যান্ডিং ম্যাটেরিয়াল। এই কাজগুলো করে থাকেন সেই প্রতিষ্ঠানের গ্রাফিক ডিজাইনার। অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে, যারা এইসব ডিজাইনগুলো ফ্রিল্যান্স ডিজাইনার হায়ার করে কাজ করিয়ে নেই। তাই আপনার যদি গ্রাফিক ডিজাইনে ভালো দক্ষতা থাকে, তাহলে আপনি দেশিয় এবং মাল্টিন্যাশনাল বিভিন্ন কোম্পানিতে ডিজাইনার হিসেবে জয়েন করতে পারবেন।
অনলাইন মার্কেটপ্লেসঃ ফ্রিল্যান্সারদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন মার্কেটপ্লেস যেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের কাজ করে ডলারে আয় করা যায়। বর্তমানে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফাইভার এবং আপওয়ার্ক। এছাড়াও পিপল পার আওয়ার, ফ্রিল্যান্সার.কম, গুরু সহ আরো বেশকিছু জায়গা রয়েছে। একজন গ্রাফিক ডিজাইনার তার কাজ এবং যোগাযোগের দক্ষতা দিয়ে মার্কেটপ্লেস থাকে ভালো উপার্জন করতে পারেন।
আউটসোর্সিংঃ আউটসোর্সিং মানে হচ্ছে একজনের কাছ থেকে কাজ নিয়ে অন্য একজনকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া। অনেক ফ্রিল্যান্সার ডিজাইনার আছে যারা নিজেদের কাজের চাপে বাড়তি কাজ করতে পারেন না। উনারা সাধারণত বাড়তি কাজগুলো নিয়ে উনার পরিচিত অন্য কেউ অথবা ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ করিয়ে নেন। তিনি মূলত মিডিয়া হিসেবে কাজ করেন এবং প্রফিট ভোগ করেন। আপনার কাজের দক্ষতা এবং যোগাযোগ দক্ষতা ভালো হলে আউটসোর্সার হিসেবে ভালো আয় করা সম্ভব।
ডিজাইন বিক্রিঃ দক্ষ ফ্রিল্যান্স ডিজাইনারদের জন্য আয় করার জন্য বেশকিছু প্রফেশনাল সাইট আছে যেখানে একবার ডিজাইন আপলোড করে রাখলে লাইফটাইম আয় করা যায়। যেমন – আপনি একটি ফ্লায়ার ডিজাইন করে সেই সাইটে তুলে রাখলেন। তারপর আপনার প্রোডাক্টটি মার্কেটিং করতে হবে যাতে করে তা বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের নজরে আসে। এভাবেই হয়তো যাদের পছন্দ হবে, তারা একটি নির্দিষ্ট মুল্যে আপনার ডিজাইনটি কিনে নিবেন। এই ধরনের সাইটগুলোর মধ্যে অন্যতম – গ্রাভিকরিভার, থিমফরেস্ট, ফ্রিপিক, শাটারস্টক।
প্রশিক্ষনঃ গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে যারা দীর্ঘদিন কাজ করছেন, তাদের অনেকেই নিজের কাজের পাশাপাশি অন্যকে শেখানোর জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এই কাজটি তারা করেন কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রধান উদ্দেশ্য থাকে অন্যকে শিখালে সে হয়তো কাজ এর মাধ্যমে উপার্জন করে তার পরিবার চালাতে পারেন। আবার অন্যকে শেখানোর মাধ্যমে নিজেরও কিছু আয় হয়, তাই অনেকে প্রশিক্ষনের সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকেন।
দক্ষ ডিজাইনার হতে হলে যে সকল বিষয় খেয়াল রাখতে হব
◉ খুব ভালো মতো কাজ শিখতে হবে।
◉ প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ঘন্টা প্র্যাকটিস করার মানসিকতা থাকতে হবে।
◉ নিজ থেকে কিছু বাড়তি কাজ করা এবং শেখার ইচ্ছা থাকতে হবে।
◉ নতুন নতুন ডিজাইন এবং টুলসের ব্যাপারে আপ-টু-ডেট থাকা।
◉ প্রতিষ্ঠিত ডিজাইনার এবং মার্কেটপ্লেসে প্রফেশনাল ডিজাইনারদের কাজগুলো ফলো করা।
◉ নিজের ভালো একটি পোর্টফলিও তৈরির ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
◉ বিভিন্ন অনলাইন এবং অফলাইন মাধ্যমে নিজের কাজের এবং পোর্টফলিও মার্কেটিং এর ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া।
◉ সময়ের কাজ সময়ে করার মানসিকতা এবং ইচ্ছা থাকতে হবে।
◉ ধৈর্য ধারন করা।
গ্রাফিক ডিজাইনারের আয়
একজন গ্রাফিক ডিজাইনার প্রতি মাসে বা প্রতি দিন কি পরিমাণ আয় করবেন তা সম্পূর্ণ তার দক্ষতার উপর নির্ভর করে। আপনি যদি লোকাল জবে জয়েন করেন, তাহলে সেখানে জয়েন করার সময় আপনার দক্ষতা এবং পজিশন অনুযায়ী সেলারি আলোচনা করে ফিক্সড করে নিতে হবে। আর আপনি যদি অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করেন, তাহলে সেখানেও আপনি ক্লায়েন্ট এর কাজ অনুযায়ী বিড করে কাজ নিতে পারবেন। আপনি যে মাধ্যমেই কাজ করেন না কেনো, দক্ষতাই আপনাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে।
সহজভাবে যদি বলি, ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে একটি বিজনেস কার্ড ডিজাইন করতে কেউ যেমন ৫ ডলায় নেয়, আবার অনেকেই আছেন একটি ডিজাইনের জন্য ১০০ ডলারের বেশিও নেন। তারাই পারেন, যাদের কাজের দক্ষতা অনেক এবং যোগাযোগের দক্ষতা ভালো।
তবে শিক্ষানবিশ পর্যায়ে কখনোই অর্থের পিছু না ছুটে দক্ষা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হন। কারন অল্প কাজ শিখে হয়তো আপনি আয় করা শুরু করতে পারবেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কখনোই মার্কেটে টিকে থাকতে পারবেন না।
কম্পিউটারের কনফিগারেশন এবং ইন্টারনেট কেমন থাকতে হবে
বেসিক গ্রাফিক ডিজাইন শেখার শুরুতে কম্পিউটার মিনিমাম কোরআই থ্রি এবং র্যাম ৪ জিবি হতে হবে। আস্তে আস্তে বেসিকটা ধরতে পারলে এবং কিছু কাজ শুরু করলে আপনি তখন প্রয়োজন বুঝেই আপগ্রেড করে নিতে পারবেন। কারন প্রফেশনাল গ্রাফিক ডিজাইনার হতে হলে কম্পিউটারের কনফিগারেশন আরো ভালো হতে হবে।
এলাকা এবং ব্যবহারভেদে ইন্টারনেট ১ এমবিপিএস থেকে শুরু করে যতোবেশী নিতে পারেন, ততো ভালো। কারন এতে আপনার কাজের গতি অনেক বেড়ে যাবে।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে হুজুগে না এসে আগে সব কিছু জেনে, বুঝে তারপর আগানো উচিত। কারন, অনেকেই ভাবেন ফ্রিল্যান্সিং মানেই অনেক টাকা, বাড়ি, গাড়ি সব হাতের মুঠোয় !! হ্যা, হাতের মুঠোয় আপনি সবই পাবেন, তবে তার জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম এবং দক্ষতা অর্জন। কারন, অর্থ উপার্জনের জন্য শর্টকাট বলতে কিছু নেই।